নিউজস্বাধীন বাংলা :‘নয়ন আমাকে প্রতিদিনই মারধর করে। ও আমাকে মেরেই ফেলবে। তোরা আমাকে বাড়ি নিয়ে যা। এখানে থাকলে হয়তো আমার লাশ পাবি। আমি আর এখানে থাকতে চাই না।’ ভিডিও কলে ছোট বোন মিমকে এসব কথা বলছিলেন সুমাইয়া আক্তার বর্ষা। কিন্তু এই কথাগুলো বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিজের শোবার ঘরের বিছানার উপর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
বর্ষার ছোট বোন মিম কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলেন, বর্ষার চোখে মুখে একটা ভয় আর আতঙ্ক কাজ করছিলো। তার কণ্ঠে ছিলো বেঁচে থাকার আকুতি। কিন্তু মাত্র ৫ লাখ টাকা যৌতুকের জন্য তাকে আর বাঁচতে দেওয়া হলো না। নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হলো। নয়নের ফাঁসি চাই। ওরে ফাঁসি দ্যান।
অভিযোগ উঠেছে, ৫ লাখ টাকা যৌতুকের জন্য প্রায় মারধর করা হতো সুমাইয়া আক্তার বর্ষা (২২)’কে। রোজকার মতো ঘটনার দিনও বর্ষার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান নয়ন তার দাবিকৃত ৫ লাখ টাকার জন্য বর্ষাকে মারধর করে। একপর্যায়ে পাষÐ নয়ন শ্বাসরোধে হত্যা করে বর্ষাকে।
সোমবার (১৯ আগস্ট) রাত দশটার দিকে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের আলী সাহার্দী এলাকায় বর্ষার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে আনুমানিক পৌনে আটটার দিকে বর্ষা তার স্বামীর নির্মম নির্যাতনে খুন হন।
নিহত বর্ষা রাজধানীর কদমতলী থানার দনিয়া শরাইল এলাকার বাসিন্দা মঞ্জুর ভ‚ঁইয়ার বড় মেয়ে। এ ঘটনায় পুলিশ বর্ষার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান নয়নকে আটক করেছে। সে আলী সাহার্দী এলাকার শহিদুল্লাহ মিয়ার ছেলে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে সুমাইয়া আক্তার বর্ষার বয়স ছিলো প্রায় সতের। বিয়ের বয়স হয়নি। তারপরও ছেলে দেখতে শুনতে ভালো তাই বিয়েতে অমত করেননি মঞ্জুর ভূইয়া ও তার স্ত্রী শিউলী আক্তার। ঘটা করেই মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সেসময় আসাববপত্র ও স্বর্ণালঙ্কার বাবদ দশ লাখ টাকাও খরচ করেন। বিয়ের পর তাদের সংসার ভালোই চলছিলো। দাম্পত্য জীবনে মুসকান নামে একটি কন্যা সন্তানও জন্ম নেয় এই দম্পতির ঘরে। বর্তমানে তার বয়স ৪ বছর। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় গেল এক বছর পূর্বে মঞ্জুর ভূইয়া তার একটি জমি বিক্রি করার পর।
বর্ষার স্বজনদের দাবি, মোস্তাফিজুর রহমান নয়ন এমএস নীট কোম্পানীতে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলো। কিন্তু গত দুই বছর পূর্বে তার সে চাকরিটি চলে যায় তথা কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রæতিতে বেকার অবস্থায় মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে নয়ন। এরমধ্যে এক বছর পূর্বে মঞ্জুর ভূইয়া একটি জমি বিক্রির টাকা পেলে নয়ন ব্যবসা করার অজুহাত তুলে ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে শ্বশুর বাড়ি থেকে। এ নিয়ে বর্ষাকে প্রায় মারধর করতে শুরু করে সে। এরমধ্যে ৩০ জুলাই বর্ষাকে মারধর করে তার মেয়ে মুসকানসহ দনিয়া পাঠিয়ে দেয় নয়ন। এবং তার দাবিকৃত ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসতে বলে।
মঞ্জুর ভূইয়া বলেন, জমি বিক্রি করার টাকাটা আমি ব্যবসা বিনোয়গ করে ফেলি। যার কারণে হাতে টাকা ছিলো না। তারপরও মেয়ে এবং নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কথা দিই সাধ্যমত তার চাহিদার টাকাটা দেব। এভাবে বুঝিয়ে ১০ আগস্ট নয়নকে ডেকে এনে মেয়েকে তার সাথে আলী সাহার্দী পাঠিয়ে দিই।
তিনি বলেন, যৌতুকের দাবিকৃত টাকা দিতে দেরী হওয়াতে নয়ন নিয়মিতই বর্ষাকে নির্যাতন করতে শুরু করে। এরমধ্যে ১৯ আগস্ট বিকেল পৌনে ৫ টার দিকে আমার ছোট মেয়ে মিমের ইমো নাম্বারে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে বর্ষা। তখন সে কান্না করে তার উপর বয়ে যাওয়া নির্যাতনের কথা বলতে থাকে। সেই সাথে জানানো হয়েছিলো যৌতুকের টাকা আজকের মধ্যে না পেলে আমাকে মেরেই ফেলবে। এর কয়েক ঘণ্টা পর পৌনে ৮ টার দিকে মেয়ের শ্বশুর শহিদুল্লা মিয়া আমাকে ফোন করে জানায়, বর্ষার অবস্থা ভালো নয়, দ্রæত তাদের বাড়িতে আসতে।
মঞ্জুর ভূইয়া কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেন, ফোন পেয়ে আমি ও আমার স্ত্রী এবং বড় ভাই দ্রæত মেয়ের শ্বশুর বাড়ি বন্দরে যাই। গিয়ে অসংখ্য লোকজন দেখতে পাই এবং মেয়ের নিথর দেহ তার শোবার ঘরের বিছানার উপর পড়ে থাকতে দেখি। তখন ঘটনাস্থলে পুলিশও ছিলো। মেয়ের গলায়, থুতনিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাই। নয়ন আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলছে। সে মানুষ না। অমানুষ। আমি ওই অমানুষটার ফাঁসি চাই।
বন্দর থানার অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, নিহত বর্ষার মরদেহের সুরতহাল পর্যবেক্ষণে গলায়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে বর্ষার বাবা মনজুর ভ‚ঁইয়া বাদি হয়ে বর্ষার স্বামী নয়নকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। সেই মামলা গ্রহণ করে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, আসামি নয়নকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। লাশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের পর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।