এক. ১৯৫৪ সালে ঢাকার মুষ্টিমেয় সাংবাদিককে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাবের গোড়াপত্তন হয়।
দুই. পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান স্থানে অর্থাৎ ১৮ তোপখানা রোডে সরকারের অস্থায়ী বরাদ্দকৃত বাংলো প্যাটার্নের লাল রঙের দ্বিতল বাড়িতে ক্লাবটি পরিচালিত হয়। এই বাড়িটিতে প্রথম বসবাস করতেন মুসলিম লীগ মন্ত্রী সভার সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ও পরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী আবু হোসেন সরকার। ১৯৫৪ সালের ৩১মে পূর্ববঙ্গে সংবিধানের ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হলে আরও অনেক বাড়ির মত এ বাড়িটিও খালি হয়।
তিন. মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা প্রাদেশিক গভর্নর থাকাকালে তাঁর চীফ সেক্রেটারি নিয়াজ মোহাম্মদ খানের কাছে ১৮ তোপখানা রোডের বাড়িটি প্রেস ক্লাবের জন্যে বরাদ্দ চান তৎকালীন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও বার্তা সংস্থার সম্পাদকদের সংগঠন প্রেস কনসালটেটিভ কমিটির নেতারা। অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন- সে সময়ের সিনিয়র সাংবাদিক খায়রুল কবীর, সৈয়দ নূরুদ্দিন, আবদুল ওহাব ও পিএম বালান। প্রাণের ঠিকানা হিসেবে অস্থায়ী বরাদ্দ পেতে তারা সমর্থ্য হন।
চার. প্রেস ক্লাবের প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি মনোনীত হন দৈনিক আজাদের তৎকালীন উপ-সম্পাদক মুজীবুর রহমান খাঁ। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন সংবাদের জহুর হোসেন চৌধুরী।
পাঁচ. `পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব‘ স্বাধীনতার পর মুখে মুখে `জাতীয় প্রেস ক্লাব‘ নামে উচ্চারিত হতে থাকে। ১৯৭৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভায় গঠনতন্ত্রের সংশোধনী পাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে `জাতীয় প্রেস ক্লাব‘ নামকরণ করা হয়।
ছয়. ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ ছিল এক বছর। ১৯৭৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরের গঠনতন্ত্র সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ দুই বছর করা হয়।
সাত. স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকার বর্তমান ক্লাবের জায়গাটি সচিবালয়ের অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এর পরিবর্তে রমনা পার্কের বিপরীতে শিল্পকলা একাডেমী সংলগ্ন এক বিঘা জমি লীজে বরাদ্দ করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরাদ্দের ঘোষণা দিলেও বরাদ্দপত্রে সই করেন ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ এর পর বাকশাল সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
আট. তৎকালীন পূর্ত সচিব মইনুল ইসলাম ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুন বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাৎক্ষণিক শিল্পকলা একাডেমী সংলগ্ন জায়গা তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে `জাতীয় প্রেস ক্লাবের নিজস্ব সম্পত্তি‘ লিখে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন।
নয়. অল্প কিছু দিনের মাথায় শিল্পকলা একাডেমী লবিং-তদবীর করে প্রেস ক্লাবের জন্যে বরাদ্দকৃত জায়গা তাদের কমপ্লেক্স নির্মাণে প্রয়োজন পড়বে বলে জানায়। সেখানে প্রেস ক্লাব করা যাবে না বলে শক্ত অবস্থান নেয়। সরকারও যুক্তি মেনে নেয়। তথ্যমন্ত্রী আকবর কবীর ক্লাব সভাপতি এনায়েতুল্লাহ খান ও সাধারণ সম্পাদক এ এস এম হাবিবুল্লাহকে এ কথা জানিয়ে বিকল্প ভাবতে বলেন। অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় ক্লাবের নিজস্ব জায়গা ও ভবন।
দশ. পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর প্রথম বারের মত ক্লাবে আয়োজন করা হয় বাৎসরিক ডিনারের। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমান্ত্রণ জানানো হয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে। সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকে। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে ক্লাবের সেই প্রথম বার্ষিক ডিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এগারো. হলিডে সম্পাদক ও ক্লাব সভাপতি এনায়েতুল্লাহ খান ডিনারের স্বাগত ভাষণে ১৮ তোপখানা রোডের বর্তমান জায়গাটি ক্লাবের জন্যে স্থায়ী বরাদ্দের দাবি তুলেন। এ স্থানের সঙ্গে সাংবাদিকদের আবেগের বিষয়টি বর্ণনা করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে তা মেনে নিয়ে জমি বরাদ্দ, পুরনো বিল্ডিংয়ের মূল্য পরিশোধ এবং নতুন ক্লাব ভবন (বর্তমান ভবন) নির্মাণের সম্পূর্ণ খরচ বহনের ঘোষণা দেন।
বারো. একই সঙ্গে ক্লাবের তহবিলে আড়াই লাখ টাকা অনুদান এবং পুরনো ভবনের মূল বাবদ ৬২ হাজার টাকা সরকার পরিশোধ করবে বলেও ঘোষণা করেন।
তেরো. এর কিছু দিন পর ক্লাব পরিদর্শনে আসেন প্রিন্স করিম আগা খান। তাঁর সম্মানে ক্লাব প্রাঙ্গণে ভোজ সভার আয়োজন করা হয়। আগা খান ক্লাব ভবনের জন্যে ১০ লাখ টাকা অনুদান ঘোষণা করেন। ক্লাব ভবনের একটা উইং আগা খানের নামে করারও ঘোষণা আসে ক্লাব নেতাদের পক্ষ থেকে। ক্লাব আঙ্গিনায় প্রথম বারের মত জমজমাট ভোজ অনুষ্ঠানটি আয়োজনের খরচ যোগান দেন পরে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভার তথ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খান।
চৌদ্দ. ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্লাব ভবনের ভিত্তি স্থাপনের জন্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আমন্ত্রণ জানান পরের সভাপতি ও বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক শহীদুল হক। এনায়েতুল্লাহ খান তখন জিয়া মন্ত্রিসভার সদস্য। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান বর্তমান জায়গাটি প্রেস ক্লাবের নামে দলিলের মাধ্যমে বরাদ্দ সম্পন্ন করেন এবং ভবন নির্মাণের সমুদয় খরচ সরকারের পক্ষ থেকে বহনের ব্যবস্থা করেন। প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ২৫ লাখ টাকা।
পনেরো. ৩০ মে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম ট্রাজেডিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারও জিয়াউর রহমানের ঘোষণার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভবন নির্মাণের অর্থ সরকার থেকে বরাদ্দের ধারাবাহিকতা রক্ষা করায় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
তথ্যসূত্র : সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এস এম হাবিবুল্লাহ ও আবদুল মতিনের নিবন্ধ।