মহাগ্রন্থের বিধি-বিধান যেমন বিশ্বের কোনো দেশসীমায় আটকাতে পারেনা; ঠিক তেমনি সাংবাদিকতাও কোনো দলীয় নিয়ম-শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হতে পারেনা। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, নানা বিভাজনে বিচ্ছিন্নাবস্থায় এদেশের সাংবাদিকতা পরিলক্ষিত। ১. বাণিজ্যিক সাংবাদিকতা ২. দলীয় সাংবাদিকতা ৩. বাহিনী সাংবাদিকতা।
অনিয়ম আর দুর্নীতি ছাপিয়ে রেখে ব্যবসা পরিচালনায় সাফল্য এনে দিয়েছে বাণিজ্যিক সাংবাদিকতায়। আর এই বাণিজ্যিক সাংবাদিকতার প্রবর্তক সাংবাদিকরা আলিশান বাড়ি-গাড়ি পেলেও সাধারণ সাংবাদিকরা এখন একটা বিজ্ঞাপনও পায়না বলে তাদের পায়ে ছেড়া সেন্ডেল আর কাঁধের ঝুলি ছিড়ে ছিড়ে পড়ছে। চোখে অশ্রু ঝরছে। অর্থকষ্টে জর্জরিত জীবন অবসান ঘটছে। এমতাবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন আর অনুদান প্রদানের গর্ববোধ সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার শামিল বলে মনে করেন এনএনসির গবেষণা বিভাগ।
আজ ক্ষমতাসীন একটি দল সাংবাদিকদের অসহায়ত্বে হাত বাড়িয়ে বড়ত্ব মহত্ব প্রকাশ করছে। কাল আরেকটি দল ক্ষমতায় এসে একই ট্রাস্টের ঝুঁড়ি থেকে কুড়িয়ানা দিয়ে করতালিতে সমাবেশের সাফল্যচিত্র সংবাদে প্রচার করবে। সাংবাদিকদের হাত নিচে নেমে গেলে আর সমালোচনাতো দূরের কথা তার দিকে ফিরে তাকাবারও মানসিকতা থাকেনা কৃতজ্ঞতা বোধের কারণে। অতএব বলা যায় এই ট্রাস্ট দেশের সাংবাদিকদের বারবার ফ্রাস্ট্রেটেড করবে প্রতিটি ক্ষমতাসীন দলের কাছে।
দলকানা না হলেও দলদরদি হতে হয়; না হয় সে দলদারি করে কখনো সাফল্য অর্জন করতে পারবেনা। নৌকায় উঠে কেউ বিপক্ষে গেলে যে চুবানি না খেয়ে সরাও যায়না তা বুঝতে ইউটিউবই এখন যথেষ্ট। সুতরাং রাজনৈতিক দলভুক্ত সাংবাদিক ভিন্ন দলের সমালোচনা করতে পারলেও নিজ দলের ত্রুটি প্রকাশ তার জন্য কখনোই সম্ভব হবেনা যদি সে রাজনৈতিক মতাদর্শে নিজেকে সাফল্যের চুড়ায় তুলতে চায়। অবশ্য স্বার্থসিদ্ধির মতলবে কোনো সাংবাদিক কোনো দলের পদ পদবি গ্রহণ করলে তা হবে সাময়িক; কখনোই সেই পদ স্থায়ী হবেনা তার জীবনে। দেশের বিভিন্ন মতাদর্শে গঠিত দলের নেতাদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যে অর্থ আসতো মিডিয়া হাউজে। সে অর্থ আসার পথ প্রায় রুদ্ধ দলীয় সাংবাদিকতার কারণে।
দেশ রক্ষায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রতিটি বাহিনীতেই অতি উৎসাহি কতিপয় সদস্যদের দ্বারা দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়। বিপদগামি সে সব সদস্যরা সাংবাদিকদের সমীহ করতেন। কিসের মিডিয়া সেল এখন তারাই সাংবাদিকতা শুরু করে দিয়েছেন। র্যাব নিউজ, ডিএমপি নিউজ, বাংলাদেশ পুলিশ নিউজ সাইট ভিজিট করলেই তাদের নিজস্ব সাংবাদিকতার সাফল্যচিত্র দেখতে পারেন। দেশের অন্যসব সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকদের তারা এখন ভাড়াটিয়া সাংবাদিক হিসেবে ভাবতেই পারেন তাতে আর আপত্তি কিসের?
দেশের সর্বক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াসুলভ আচরণের সম্মুখীন সাংবাদিকরা এখন পথেঘাটে মার খাচ্ছে। হচ্ছে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। সর্বশেষ কুষ্টিয়ার সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেলের (৩১) লাশ গড়াই নদে ভেসে ওঠা দেশের সাংবাদিকতার সংকটকালের স্বাক্ষী। সাংবাদিকদের আত্মমর্যাদাবোধোদয় ও ঐক্যবদ্ধ না হলে দেশের সাংবাদিকতার সংকটকালাতিক্রম হবেনা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সাংবাদিকদের ঐক্যের মাধ্যমে দেশে সাংবাদিকদের হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরে আসবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। স্বাধীন সোনার বাংলায় সরকার বদল হবে কিন্তু সাংবাদিকতার বদল হবেনা। তাদের মর্যাদা সুউচ্চ রবে চিরকাল এমনটাই প্রত্যাশা। আর সে প্রত্যাশা পূরণে বাণিজ্যিক, দলীয় ও বাহিনীর বৃত্তায়নের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে সাংবাদিকদের।
লেখক- গবেষক মাসুম বিল্লাহ, সম্পাদক- সংগ্রহ বার্তা ও প্রেসিডেন্ট- এনএনসি