আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গলো হাসপাতালের কল পেয়ে। গত রাত থেকে আব্বা নাকি রেসপন্স করছে না। দৌড়ে ছুটলাম।
হাসপাতালে গিয়ে অপেক্ষা ডাক্তারের। বেলা ১২ নাগাদ ড. গুরুদাসের নেতৃত্বে ৬ থেকে ৭ জনের একটি টিম এলো। তিনি আব্বাকে ডাকলেন, হাত ধরলেন তেমন কোন সাড়াশব্দ নাই। ডক্টর গুরুদাস সিটি স্ক্যানের ফটো হাতে নিয়ে জুনিয়রদের দেখিয়ে বললেন, এই যে দ্যাখো, পেশেন্টের স্ট্রোক কিন্তু বড় সড়। এখন ডিটরয়েড করেছে। পুরো ব্রেইনে ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষুনি আর্জেন্ট একটা সিটি স্ক্যান করে দেখতে হবে। নার্স বা কোন একজন স্টাফ বললেন, এখন তো হবে না। আগামীকাল করাতে হবে। ডক্টর গুরুদাস ক্ষেপে গিয়ে গেলেন, এক্ষুনি হবে। উনি একজন ফ্রিডম ফাইটার। উনার জন্যে আমরা সর্বোচ্চ করবো। উনার সিটি স্ক্যান ফ্রি হবে এবং আর্জেন্ট। আমি বললাম, ফ্রি লাগবে না, আমি টাকা দিচ্ছি। ডক্টর বললেন, নো, আমি নিজেই কাগজ নিয়ে যাচ্ছি।
তারপর কিসের মধ্য দিয়ে যে গেছি কিচ্ছু বলতে পারবো না।সিটি স্ক্যান করে ছবি হাতে নিয়ে বললেন, ওহ মাই গড। ক্রিটিকেল অবস্থায় চলে গেছে। আরও কিসব কিসব বললেন বুঝলাম না। আমি ডক্টর সেলিম শাহীকে কল দিলাম। প্রথমে কল রিসিভ করেননি। পরে ব্যাক করে বললেন, আপনার বাবার বিষয়ে আলাপ হচ্ছে। ডক্টর গুরুদাস আমার সামনে। তার কিছু পরে ডক্টরদের একটি টিম এসে জানালেন, এখন সিচুয়েশন খারাপের দিকে, আর্জেন্ট অপারেশন করাতে হবে। তবে অপারেশনেও ঝুঁকি আছে । ফোর থেকে ফাইভ পারসেন্ট সম্ভাবনা ব্যাক করার। আপনারা চান্স নেবেন কি না? তবে অপারেশন ছাড়াও কোন উপায় নেই। আবার চাইলে আপনারা বাইরেও যেতে পারেন।
আমি ডক্টর গুরুদাস আর সেলিম শাহীর যে বডি ল্যাংগুয়েজ দেখেছি তাতে সন্তুষ্ট, তারা নিজেদের আপনজন ভাবছেন আমার বাবাকে, এর চেয়ে ভরসা আমি আর কোথাও, কারো উপরে করতে পারবো না। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম, এখান থেকে আমি কোথাও যাব না। নীচে ডাকা হলো আমাকে। গিয়ে দেখি প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ নিউরো সার্জনের সাথে কথা বলছেন মোবাইল ফোনে। নিউরো সার্জন বললেন, এই পেশেন্টের ব্যাক করার চান্স কম। বডির যা কন্ডিশন অপারেশন করা ঝুঁকি। মোবাইলের অন্য পাশ থেকে প্রফেসর দীন মোহাম্মদ সিদ্ধান্ত দিলেন, অপারেশন করেন ফ্যামিলি রাজি থাকলে। নিউরো সার্জন ফোন রেখে আমাকে বললেন, আপনার পেশেন্টের কনডিশন খুব ক্রিটিক্যাল, ব্যাক করার চান্স ৫ পারসেন্ট। এই অবস্থায় আপনারা সিদ্ধান্ত দিলে অপারেশন হবে। বললাম, প্রফেসর দীন মোহাম্মদ যা বলবেন তাইই করবো। আমি দীন মোহাম্মদ স্যারের সাথে একটু কথা বলব। ব্যবস্থা হলো দেখা করার। উনার রুমে ঢুকেই চিনে ফেললাম সুপারম্যান প্রফেসর দীন মোহাম্মদকে। পনের বছর আগে জমের সাথে লড়াই করে আমার বোনকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, আপনি সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ঠোঁটের কোনায় চিলতে হাসি ঝুলিয়ে বললেন, অপারেশন করে ফেলেন। চান্স কম, তবু লেটস গেট দ্যা চান্স। অপারেশনের কাগজে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে মাথাটা চক্কর দিলো। মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর দিচ্ছি না তো?
ডক্টররা জানালেন, ব্লাড রেডি রাখেন। আমি ও নেগেটিভ ব্লাড সন্ধান করে হয়রান। হাজার ফোন আসছে। সবাইকে বলছি, ব্লাড জোগাড় হলে অপারেশন হবে। রোজার দিন হওয়ায়, ইফতারের পরে ডোনাররা ব্লাড দিতে চাইলো। হঠাৎ ডাক পড়লো, অপারেশন থিয়েটারের কাছে। দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ডক্টর অপারেশন ইফতারের পরে করলে হয় না? ডোনার যাদের পেয়েছি, তারা ইফতারের পরে ব্লাড দিতে পারবে। নিউরো সার্জন ডক্টর মুকুল জানালেন, আপনার বাবার অপারেশন হয়ে গেছে। ব্লাড লাগবে না। প্লাজমা সেলে হয়ে গেছে। এখন একটু বেটার মনে করছি। তবে পেশেন্ট ঝুঁকিমুক্ত না। আমি বিস্মিত। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এত সুন্দর ভাবে, পরিকল্পনা করে এমন জটিল অপারেশন সম্পন্ন কিভাবে করে ফেললো।!
প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ ও আপনার টিমকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা! এই ঋণ শুধিবার নয়!
(আব্বা এখনো ঝুঁকিমুক্ত নন, মাথার খুলি ওপেন করা, আগামীকাল সাভারে প্রিজার্ব করতে যাবো, সুস্থ্য হলে ছয়মাস পরে আরেকটা অপারেশনের মাধ্যমে সং যুক্ত করা হবে। -শামীমা দোলা)