মানুষের সামান্য জ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কৃত কেবল বিদ্যুতের আলোই নয়; বরং বিশ্বকে অন্ধকার থেকে প্রতিদিন রেহাই দানকারি সূর্যের আলোর সাথেও মহামূল্যবান জ্ঞানের আলোর তুলনা হয়না। আর এই অতুলনীয় জ্ঞানের প্রদীপ আজ নিভু নিভু। জ্ঞানের প্রদীপ নিভে গেলে দিনের আলোয় খুন ধর্ষণসহ সব ধরণের অপরাধ সংঘটিত হবে। অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে আমাদের সহস্রসালের সাজানো এ বৈশ্বিকগ্রাম।
চিরঅন্ধত্বের কাছে আলো আঁধারের মূল্যায়ন আশা করা যেমন ভুল। তেমনি জ্ঞানের আলোহীন মূর্খের কাছে ন্যায় অন্যায়ের সুবিচারের আশা করাও ভুল। মেথরের কাছে দুর্গন্ধ যেমন মিটে যায়। ডুমের কাছে আতঙ্কে কেঁপে ওঠা যেমন স্বাভাবিক হয়ে যায়। তেমনি মূর্খের কাছে অন্যায় অপরাধের ভয়াবহতা সাধারণ ব্যপারে পরিণত হয়ে যায়।
জ্ঞানহীন মানব যেমন সূর্যহীন বিশ্ব। সূর্যহীন বিশ্বের বুকে পুষ্পের ছোঁয়া আর কাটার আঘাত উভয় যেমন একাকার হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক তেমনি জ্ঞানহীন মূর্খ লেবাসধারী সভ্য স্মার্টদের কাছে বৈধ আর অবৈধও সমমূল্যায়িত হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
বিবেককে বড় বিচারালয়ের সাথে তুলনা করা হয়। সেই বিবেক আর বিবেচনার উৎস হচ্ছে জ্ঞান। চলমান এ+ আর সনদধারীদের পুথিগত বিদ্যাই যথেষ্ট নয়। পুথিগত বিদ্যা কেবল জ্ঞানার্জনের সিড়িতে তুলে দেয়। দেশের প্রচলিত সর্বোচ্চ শিক্ষা সনদ এমএ ডিগ্রী নিয়েও যে কতটা জ্ঞানের আলো বিমুখ তার প্রমাণ তাদের নানাবিধ অপরাধের সংবাদচিত্র। একজন সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী যেখানে আত্মহত্যার বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে মনে করে, যে পুথিগত বিদ্যায় সামান্য আত্মসংযম আর মূল্যবোধ উদয় হয়না, সে বিদ্যায় আজ ব্যক্তি, সমাজ আর সরকার মিলে দেশের বৃহদাংশ অর্থ অযথাই বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে।
অধিকাংশ সনদধারী মূর্খেরা আজ পিয়ন থেকে সচিব আর তৃণমূল থেকে জাতীয় সংসদ/আইনসভা পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। তার প্রমাণও সংবাচিত্রে ফুটে উঠছে। নির্বাহী দায়িত্ব নিয়েও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্র ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় বর্তমান অধিকাংশ নির্বাহী মেজিষ্ট্রেট/বিচারকগণ।
সরকারের সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়; এ লেখা তরুণদের জ্ঞান সাধনায় প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে। বৈশ্বিক গ্রামবাসী হিসেবে আমি ধন্য, আমি গর্বিত। জ্ঞানার্জনে আমি মূহুর্তের মধ্যে ছুটে চলি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। যতক্ষণে আমার সে জ্ঞান পিপাসা না মেটে ততক্ষণ আমি নজরুলের উল্কা হয়ে উড়ে বেড়াই সুউচ্চাকাশে আর ঝড়ের মত ছুটে চলি দিগদিগন্তে। আন্তর্জাতিক জালে/ইন্টারনেটে উঠে আসে সব জ্ঞানার্জনের তথ্য সমারোহ। আমার লক্ষে পৌছতে নানাভাবে বাধা আসে এই আন্তজালে। আমি যখন পবিত্রমনে ছুটে চলি সামনে তখনই আমায় ধরাছোয়ার বাইরে থেকে অপবিত্রদেহে আগলে ধরে পিছে ফিরে আসতে বাধ্য করে। যৌবনকাল পেরিয়ে আসা কোনো পুরুষকে ঘায়েল করতে না পারলেও তরুণ প্রজন্মের জন্য যত ভয় আর দ্বিধাদ্বন্দ মোর।
আমার সন্তানের জ্ঞানার্জনের জন্য স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার আর যত তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধা দিয়েছি। কিন্তু সে শিক্ষার্থী সন্তান তার লক্ষে পৌছার অনেক আগেই যে ললনার ছলনায় আর কুপ্রবৃত্তির তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার খবর কে কত রেখে চলছি? অনাবৃত ভার্চুয়াল জগতে ঘুরে এসে নানা নিয়ম-কানুনে আবৃত সমাজের সাথে খাপ খেয়ে চলতে যে তার চরমাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে সে ব্যপারে আপনার ভ্রুক্ষেপ না থাকা ভবিষ্যতের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে?
সুকুমার চর্চার জায়গা কুপ্রবৃত্তি চর্চায় দখল করেছে। জ্ঞান সাধনার জায়গা অর্থ উপার্জন সাধনায় দখল করেছে। চলুক, চলনে দাও। আমাদের সন্তানরা তাদের হাতে থাকা তথ্যপ্রযুক্তি থেকে গোপন সঙ্গমের ষোলকলা শিখে আসছে। আর তা প্রয়োগে দৈনিক খবর কাগজে বেরিয়ে আসছে ধর্ষণের ভয়াবহ দৃশ্য। তারানা হালিম তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল দপ্তরে আমি নিজে আবেদন করেছিলাম যে, পর্ণোসাইটগুলো বন্ধ করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে বাঁচান। তিনি যা করেছেন তাতে যথেষ্ট হলে এবিষয়ে পুনরাবৃত্তি করতে হতোনা। এই কঠিন করোনা মহামারির মধ্যে রমজানের পবিত্রতায়ও হানা দিচ্ছে পর্ণোস্টাররা।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে যখন পাঠ্যপুস্তক দেয়া হয় তখন সে জ্ঞান গভীরে পৌছতে পারছেনা একটু পূর্বে দেখে আসা টাচস্কীনে দেহদোলানো দৃশ্যের দাপটে। এদৃশ্যের দাপট এতটাই যে, গভীর ধ্যানমগ্ন ইবাদতেরও বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। জ্ঞানগভীরে পৌছতে যতটা না সময় সাধনা প্রয়োজন জৈবিক উত্তেজনায় পৌছতে তেমন কোনো বেগ পেতেই হয়না বলে আজকের তরুণ সমাজ শ্রম সাধনার পথ ছেড়ে সহজে সফল হওয়ার পথে হাটছে। শুনছেনা মা-বাবা আর গুরুজনদের কাব্যকথা। বড়দের আদেশ-উপদেশ এখন তরুণদের কাছে সবচেয়ে বেসুরা সংগীত। তাই তা শোনার সময় নাই ওদের। ওদের সময়টা এখন ভালো কাটে ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করে। রাত-দিন ছোট্ট টাচস্কীনের দিকে তীর্যক দৃষ্টি। সকল চাওয়া-পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া এই ডিভাইসটি যদি এইচ.এস.সির আগে কোনো সন্তানের হাতে পৌছে সে বিনা বিদ্যালয়ে বিয়ে পাশ করে ঘরে ফিরতে পারবে বলে আমার ধারণা। ফলে যেমন সরকারেরও বাজেট বৃদ্ধি হবেনা আর মা-বাবারও টেনশন করতে হবেনা।
ভার্চুয়ালবিশ্ব থেকে শিক্ষণীয় কিছু খুঁজে বের করা যতটা কঠিন তার চেয়ে অশিক্ষা কুশিক্ষা আর অসভ্যতার যাকিছু সব অনায়াসে পাওয়া অধিকতর সহজ। জ্ঞান সাধনার সহায়ক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে একটি বয়সসীমা নির্ধারণ অতীব জরুরি। না হয় নতুন প্রজন্ম শুধু পুথিগত বিদ্যার্জন দ্বারা নতুন পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে পারবেনা। পারলেও তা স্থায়ী হবেনা। আগেই বলেছি পুথিগত বিদ্যা জ্ঞানের দরজায় পৌছে দিতে সিড়ির ন্যায় সাহায্য করে বলে কাগুজে বই আর খবর কাগজের বিপক্ষে নই। খবরের কাগজ আর কাগুজে বইয়ের বিলুপ্তিতে সভ্যতার বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে দৃঢ়তা প্রকাশ করছি। (চলবে) লেখকের পরবর্তী লেখায় থাকছে- সংবাদ ও সাংবাদিকের কথা
লেখক- আলহাজ¦ মাসুম বিল্লাহ
প্রেসিডেন্ট- এনএনসি ও
সম্পাদক- সংগ্রহ বার্তা
Email: nncpost@gmail.com