কয়েক সপ্তাহ কানাডায় ছিলাম না। ফিরে এসে দেখি এরই মধ্যে আমার সবচে প্রিয় ঋতু ফল-এ সবুজ পাতাগুলো ঝলমলে রঙিন হয়ে ঝরে পড়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে। অটোয়ায় রাতে এসেছি বলে রঙিন পাতাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। এসেই শুনলাম সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে থেমে থেমে। আমি জানি এই সময়টায় বৃষ্টি হওয়া আর প্রবল বেগে বাতাস বওয়া মানে–রঙিন পাতাদের বিদায় জানাতে প্রকৃতি ব্যাকুল।
মিলিয়ন-বিলিয়ন বৃক্ষের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সবুজ পাতার দেশ কানাডা।
সহস্রকোটি বৃক্ষের–বার্চ, ওক, পাইন, ম্যাপল এবং অন্যান্য গাছের বিস্তীর্ণ এক অভয়ারণ্য যেনো বা দেশটি। পুরো কানাডা জুড়ে সমতল কিংবা উঁচু নিচু পাহাড়িয়া ভূমি, অগুন্তি পার্ক এবং নদী-লেকের টলটলে জলের অবাধ মেলামেশায় ঘোর লাগা এক সবুজ দেশ কানাডা।
কানাডার বরফ এবং হাড্ডি-জমাট শীত বা উইন্টার সিজনটা আমার খুবই অপছন্দের। বছরের অর্ধেকটা সময় আমরা থাকি বরফ প্লাবিত। বলা চলে বরফের নিচে। হিমাঙ্কের নিচে মাইনাস থার্টি ফাইভ-ফর্টি টু পর্যন্ত এগিয়ে থাকে শীতের মাত্রা। কোনো গাছেই পাতা থাকে না একটিও। পত্রপল্লবহীন কানাডার ন্যাড়া ন্যাড়া গাছগুলো কেমন নিঃসঙ্গ ফাঁসির আসামীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
কিন্তু কয়েক মাস পরেই সামারে কানাডা খুব সুন্দর। তখন চারিদিকে সবুজের সমারোহ। অযুত বৃক্ষের নিযুত কোটি সবুজ পাতায় কানাডা থই থই করে। তবে সুন্দর কানাডা প্রচন্ড সুন্দরী হয়ে ওঠে অক্টোবরে, ফল সিজনে। এই সময়টায় কানাডার সমস্ত গাছের সবুজ পাতাগুলো ক্রমশঃ রঙিন হয়ে ওঠে। এই সময়ে হালকা হলুদ, গাঢ় হলুদ, হালকা সবুজ, টিয়ে সবুজ, চকোলেট, মেরুন, কমলা এবং লাল বর্ণ ধারণ করে বিপুল সংখ্যক পাতা। দিনে দিনে একটা পর্যায়ে হলুদ আর লালের ছোপ ছোপ রঙে বর্ণিল হয়ে ওঠে চারপাশ। জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায়–উজ্জ্বল রঙের মাতামাতি। পুরো কানাডা যেনো বা হয়ে ওঠে শিল্পী হাশেম খানের চোখ ধাঁধানো এক্রিলিকের রঙিন ক্যানভাস। এরকম গাঢ় লাল হলুদ আর সবুজের হুল্লোড় একমাত্র হাশেম খানের ক্যানভাসেই দেখা যায়।
মোহ বিস্তারি এই সময়টায় পাতাদের কাছে আমি ছুটে ছুটে যাই, বারবার। বিমুগ্ধ নয়নে দেখি সবুজ পাতার রঙিন হয়ে ওঠার অনির্বচনীয় মুহূর্তগুলো। রঙিলা এই সকাল দুপুর বিকেলগুলো গাঢ় লাল আর হলুদের আগুনলাগা ঘোরে কেমন আনন্দ-বিষাদের মিশেলে অদ্ভুত মাতোয়ারা করে রাখে।
তবে পাতাদের এই সৌন্দর্য খুবই স্বল্পস্থায়ী। পাতাদের এরকম আচমকা ঝলমলে রঙিন হয়ে ওঠার অর্থ হচ্ছে–জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার লক্ষণ। যেনো, পাতাদের চিঠি এটা, মানুষের কাছে। পাতাগুলো যেনো বা বলে যায়–হে মানুষ, তোমরা এসে দেখে যাও ছুঁয়ে যাও। আমাদের ঝরে পড়ার দিন এসেছে। তোমরা লিখে রেখো ঝরা পাতাদের গল্প।
পাতা ঝরার দিন বিষণ্ণ রঙিন।
গতকাল রাতে অটোয়ায় ফিরে ঘুমুতে গেছি যখন, তখনও বৃষ্টি টিপটিপানি বৃষ্টি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি জোর হাওয়া বইছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বৃষ্টির ছাঁট। আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। লক্ষণ সুবিধের নয়। বৃষ্টি আর বাতাসের এই বার্তা আমার চেনা। ওরা এসেছে ধ্বংসের বাণী বহন করে। যৌথ বাহিনির সাজে ওরা এসেছে অটোয়ার পাতাদের মৃত্যুঘন্টা বাজাতে বাজাতে।
বয়েসের হিংস্রতা থেকে বাঁচতে একগাঁদা অষুধ খাই প্রতিদিন দুই বেলা ভাত খাওয়ার মতো। এ মাসের অষুদের চালানের কয়েকটা আইটেম পিক আপের জন্যে রেডি, মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছে শপার্স ড্রাগ মার্ট মানে আমার ফার্মেসী। ঘর থেকে হাঁটার দূরত্বে হলেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গাড়ি ড্রাইভ করেই গেলাম। ফার্মেসীটা যে ক্যাম্পাসে, একটা সিনেমা হল থাকাতে সুবিশাল একটা পার্কিং লট সেখানে। ফার্মেসীর দিকে গাড়ি টার্ণ নিতেই দেখি–আহা আমার চির পরিচিত এই পার্কিং এলাটাকা সবুজ-হলুদ-লাল রঙের পাতার কী অপরূপ সমাবেশই না ঘটেছিলো এবার! কিন্তু আমার দেখাই হলো না! বরাবর ফল সিজনে এখানে আমি বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিন আসি।
ফার্মেসীতে যাবার আগে পার্কিং এড়িতে গিয়ে গাড়ি থামালাম। বৃষ্টি আর বাতাসের যৌথ ঝাপটা চলছে। আর আমার প্রিয় রঙিন পাতারা ঝরে ঝরে পড়ছে মাটিতে, কংক্রিটের পথে, দলে দলে। একা একা।
মনটাই বিষণ্ণ হয়ে গেলো। পায়ে পায়ে আমি এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। মোবাইল ফোনে ওদের চেহারা ধরে রাখতে ছবি তুলতে থাকলাম একের পর এক। মাটিতে পড়ে থাকা ঝরা পাতাদের দেখে কেমন একটা দুঃখবোধ আমাকে ঘিরে ফেললো মুহূর্তেই।
গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে রঙিন পাতাদের ভগ্নপ্রায় সংসার দেখতে দেখতে দেখতে ছবি তুলছি। হঠাৎ নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে অষ্ফুট কণ্ঠে বললাম–ব্যাটা আমি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলি না! আর মাত্র একটা দিন অপেক্ষা করলে কী এমন ক্ষতি হতো?
বলা মাত্রই, বৃষ্টি তো ছিলোই, বাতাসের গতি গেলো বেড়ে। সেই বাতাসের জোরাজুরিতে গাছের উঁচু ডাল থেকে একটা হলুদ পাতা ঝরে যেতে যেতে কেমন বিষাদকণ্ঠে বললো আমাকে–অপেক্ষার ক্ষমতা থাকে না আমাদের বন্ধু! কুড়ি বছর ধরে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব উদযাপন করেও এটা বুঝলি না বোকা! আমি তো তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম রে! এই যে তুই এসেছিস, এখন আমার বিদায় নেবার সময় হলো। বিদায় বন্ধু। বলতে বলতে উজ্জ্বল উচ্ছ্বল ঝলমলে হলুদ পাতাটা ভাসতে ভাসতে অদূরে পার্কিং অঞ্চলের কংক্রিটের ওপর লুটিয়ে পড়লো। আমি ওর ছবি তুলে রাখলাম কয়েকটা।
একা গিয়েছিলাম বলে, এলাকাটা নির্জন ছিলো বলে কাউকে পেলাম না আমার একটা ছবি তুলে দিতে। অগত্যা যেটা আমি করি না, পারি না, অর্থাৎ , অপটু হাতে পাতাদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি তুলে নিলাম। খুব বেশি মন খারাপ হলে ওদের দেখবো।
অটোয়া ১৩ অক্টোবর ২০২২