তখন আমরা পল্টনের জুয়েল হাউজ ছেড়ে, বাংলামোটর। ভোরের কাগজ অফিস। ১৯৯৪ সালের শেষদিক। সম্পাদক, মতিউর রহমান ( মতি ভাই)। সকাল থেকে, রাত অব্দি হৈ- হুল্লোড়। আমি ছিলাম, ৩ তলায়। সম্পাদকীয় বিভাগে, সহ-সম্পাদক হিসেবে । তখন সহকারী সম্পাদক, আব্দুল কাইয়ূম মুকুলের সহযোগী। উপসম্পাদকীয় লেখকদের তাগাদা দিতাম। মুক্তচিন্তায় নিয়মিত কলাম লিখতেন—- ফয়েজ আহমদ, আবেদ খান, আব্দুল বায়েস, এ এম এস কিবরিয়া, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, আবুল কালাম মঞ্জুর মোর্শেদ, ড. ফরাসউদ্দিন, ড. আনোয়ার হোসেন, পান্না কায়সারসহ আরও অনেকে। এছাড়াও দেখতাম, চিঠিপত্র এবং ‘জ্বলো একাত্তর‘ নামের একটি পাতা। সেই রুমে বসতেন—- আব্দুল কাইয়ূম মুকুল ভাই, আনিসুল হক ভাই, সাজ্জাদ শরিফ ভাই এবং পুঁচকে আমি। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম।
আমাদের রুমের বাইরে বসতেন– এটিএম হাই ভাই আর ঢাউস কাঁচ ঘেরা টেবিল জুড়ে, শিল্পী অশোক কর্মকার দা।
সেখান থেকে ডানে টার্ন নিলেই, একের পর এক টেবিল। সেখানে বসতেন—- মুন্নী সাহা, সুমনা শারমিন, কবির বকুল, গিয়াস আহমেদ, সাইদুজ্জামান রওশন, মাহমুদ ইকবাল এবং লম্বা টেবিল নিয়ে, সঞ্জীব চৌধুরী দাদা। তাদের উল্টোপাশে, কাঁচঘেরা রুমে মতি ভাই।
ফ্লোরের শেষ প্রান্তে ছিলো, মফস্বল বিভাগ। সেখানে বসতেন– লতিফ সিদ্দিকী ভাই, রমেন দা এবং মুনীর রানা।
এর নিচতলায় ছিলো— ডেস্ক, স্পোর্টস, রিপোর্টিং, কম্পিউটার, রিডিং, পেস্টিং এবং ফটো বিভাগ।
অমিত দা তখন ডেস্কে। শিফট ইনচার্জ। মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ভাই/ সোহরাব হাসান ভাই বার্তা সম্পাদক।
তখনও অফিস হাজিরা শুরু হয়নি। যে যার মতো, অফিসে আসতেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়েই, পত্রিকার কাজ শেষ হতো।
হঠাৎ একদিন দুপুরে দেখলাম, অফিসে কর্মচারি হাজিরা খাতা আনা হয়েছে। সেখানে উপস্থিতির জানান দিতে হবে। সারা অফিস তোলপাড়।
বিশেষ করে, অমিত দা এবং সঞ্জীব দাতো, রীতিমতো ব্যাঘ্রমূর্তি! তাদের কথা– কোনো হাজিরা হবে না। যেহেতু পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে, সেহেতু সব সাংবাদিক সময়মতো অফিস করছেন। কে, কখন এলো- গেলো– ওটা বিষয় না। প্রয়োজনে সকাল আটটায় অফিসে আসবো, রাত ১২ টায় যাবো। কিন্তু আমরা, হাজিরা দিবো না। আর আমরা, কর্মচারী না। যারা কর্মচারি, ১০ টায় আসে ৫ টায় গাট্টি বান্ধে, তারা হাজিরা দিক।
মতি ভাইয়ের মুখের ওপর কথাগুলো বললেন, অমিত দা। তার সঙ্গে সঞ্জীব দা, আনিসুল হক, মুন্নী সাহা, গিয়াস আহমেদসহ আরও অনেকে সেদিন ছিলেন।
এরপর ‘৯৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ( আমি যতদিন ছিলাম। তারপর যোগ দেই জনকণ্ঠে) হাজিরা নিয়ম চালু ছিলো না।
… ৩ তলায় রীতিমতো বাজার বসতো। একদিকে সঞ্জীব দার ‘মেলা‘, সুমনা শারমিন- এর নারী পাতা ‘ অন্যপক্ষ‘, মুন্নী সাহার ছোটদের পাতা ‘ইষ্টিকুটুম‘। অন্যদিকে, গিয়াস আহমেদের ‘ পাঠক ফোরাম‘ , কবির বকুলের ‘ বিনোদন‘ , মাহমুদ ইকবাল- এর লেখা- পড়া এবং সাইদুজ্জামান রওশন- এর রঙব্যাঙ্ পাতা। সেখানে প্রতিদিন, না হলেও ২০/৩০ জন সুন্দরী তরুণী আসতেন। আর ছেলে আসতেন, প্রায় ৩০/৪০ ! এদের অধিকাংশই প্রদায়ক। আজ ওরা, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নাম।
অমিত দা, কমপক্ষে ৪/৫ বার ৩ তলায় আসতেন। বসে থাকতেন, সঞ্জীব দার সামনে। একের পর এক, সিগারেট খেতেন। আর সঞ্জীব দার টেবিলের নিচে থাকতো, লাল- সাদা পানি! অধিকাংশ সময়, লাল চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেতেন। বলতেন– শোন, এসব না খেলে জীবনটা বৃথা। মেধাবীরাই এসব খায়! যারা খায়, সবাই কিন্তু মেধাবী না। বুঝলি কিছু? হা হা হা …!
একদিন সঞ্জীব দা, অমিত দাকে হাসতে হাসতে বললেন—- অমিত, আপনার কোনো কাজ নাই?
—- আছে তো! আপনার কাছে… এরপর দুজনই হো হো করে হেসে উঠলেন।
বলাবাহুল্য- অবিবাহিত অধিকাংশ সম্পাদকীয়+ ফিচার বিভাগের সাংবাদিক, কোনো না কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন! যাদের অনেকেই, বর্তমানে স্বামী- স্ত্রী ।
সঞ্জীব দা চলে গেছেন, আগেই। আজ অমিত দাও, অতীত। আহ্, জীবন!
পুনশ্চ: জনকন্ঠ পত্রিকায় থাকতেই খবর পেলাম, অমিত দার ইচ্ছাপূরণ হয়েছে। নতুন জীবনে, অনেক ভালো থাকবেন, প্রিয়জন।
(Tapas Raihan) -মিডিয়াওয়াচ থেকে সংগ্রহীত