গত ১৯ জুন কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসে রাজধানী ঢাকার একটি ব্যাংকের ঠিকানায় ফরিদপুর থেকে ৩টি ভারী কাটুন আসে। দুপুর ১ টার দিকে কুরিয়ার কর্মী রিক্সাযোগে ছোট বড় ৩টি কাটুন নিয়ে যথাযথ ঠিকানায় হাজির হয়। কাটুন ৩টি ব্যাংকের সামনে নামিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালা চলে গেলে কুরিয়ার কর্মী পড়েন বিপাকে। একদিকে সে কাটুনগুলো একা তুলে নেওয়ার মতো নয়; অন্যদিকে সেগুলো রেখে সরলে চুরি যাওয়ার ভয়। এমতাবস্থায় দিশেহারা কুরিয়ার কর্মী ছুটে যায় উক্ত ভবনে কর্মরত সিকিউরিটি গার্ডের কাছে। একাধিক সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে তার অসহায়ত্বের বিষয়টি জানালেও কেউ তাকে সহযোগিতা করতে আসাতো দূরের কথা; তারা কুরিয়ার কর্মীকে হেনস্থা করে।
কুরিয়ার কর্মী বারবার ২য় ও ৪র্থ তলায় সংশ্লিষ্টদের কাছে ভারী কাটুন পৌঁছে দেওয়ার সমস্যার কথা জানালেও তারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। তারপর একাই ৩টি কাটুন ঘাড়ে পিঠে আর ফ্লোরে টেনে হিচড়ে ৪ তলায় পৌছে দিয়ে রিসিভ কপি সংগ্রহ করে। সারা শরীর ঘামে ভেজা তারওপরে পানির পিপাসায় মুখ শুকিয়ে গেছে। এমন চরমাবস্থায় ভবনের ৪ তলা থেকে নেমে এসে পড়েন সেই সিকিউরিটি ইনচার্জের রোষাণলে।
কেন তার কাটুন অফিসারের পায় লাগল? সেটাই তাদের কাছে অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছিল। তাদের থেকে কেউ এগিয়ে এলে মানবিক বিষয়টি যেমন গুরুত্ব পেতো তেমনি কারো গায় পায় লাগারও আশঙ্কা থাকতোনা। অথচ মানবিক বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে নারী সিকিউরিটি গার্ডসহ একাধিক গার্ড ও উপস্থিত জনতার সামনে একজন কুরিয়ার কর্মীর সাথে এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়; যা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারেনা।
আসলে আমরা বাঙালি এখন কোন আদর্শের অনুসারি? সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। ওয়েষ্টার্ণ কালচারে- এক্সকিউজ মি, মে আই হেল্প ইউ ও এনি হেল্প শুধু কথায় নয়; কাজে তারা একে অপরের সহযোগি মনোভাব প্রকাশ করছে। সামান্যতে সরি বলা তাদের আচার ব্যবহারের সূচনাংশ। অথচ আমরা মুসলমান। ইসলামের কোন শিক্ষা আমাদের আচার ব্যবহারে কিংবা কার্যক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে?
সকালের রোদ কেবল আলো ছড়াচ্ছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নবীজি (সা.) বেরিয়েছেন মক্কার গলিতে। দেখলেন একজন বৃদ্ধাকে। মাথায় ভারী বোঝা নিয়ে হাঁটছেন। নবীজি এগিয়ে এলেন বুড়ির দিকে। তার মাথার ভারী বোঝাটা নিজের মাথায় তুলে নিলেন। এরপর চলছেন বুড়িকে পৌঁছে দেয়ার জন্য।
ভারী বোঝা মাথা থেকে সরলে বুড়ির মন হালকা হল। নবীজির পাশে হেঁটে হেঁটে বলে যাচ্ছেন মনের যত ব্যথা। একপর্যায়ে বলছেন, ‘আমরা খুব ভালো ছিলাম। সংসারে কোনো ঝামেলা ছিল না। মুহাম্মদের ওপর কোন ভূত সওয়ার হল, সে আমাদের সংসারে ফাটল ধরাল। ভাইবোন, বাপ-ছেলে এবং মা-মেয়ের মাঝে সংঘাত লাগিয়ে দিল। তার যন্ত্রণায় মক্কায় থাকা যাচ্ছে না। ভাবছি অন্যত্র চলে যাব।’
রাগ ঝাড়লেন বুড়ি। ধৈর্যের পাহাড় নবীজি (সা.) চুপচাপ সব শুনলেন। গন্তব্যে গিয়ে বোঝা নামাতেই বুড়ি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে বাবা? আমার এত বড় উপকার করলে। তোমার নাম কী?’
নবীজি বললেন, ‘এতক্ষণ আপনি যাকে গালমন্দ করলেন আমিই সে মুহাম্মদ।’ শুনেই বৃদ্ধা নবীজির পায়ে পড়ে বললেন, ‘তুমি তো মানুষ নও, দেবতা- ফেরেশতা! মানুষ তোমার সম্পর্কে কেন এত কুৎসা রটাচ্ছে? এক্ষুনি তোমার কালেমা আমাকে পড়াও। আমি মুসলমান হয়ে যাব!’
এই ছিল মহানবীর মানবসেবা। মানবসেবায় তিনি ছিলেন জীবন্ত উপমা। নবুয়তি লাভের আগেই মানবসেবায় গড়ে তুলেছিলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ সেবামূলক সংগঠন। তার কাছে সাহায্য চেয়ে পায়নি- এমন মানুষের সংখ্যা মেলানো ভার। নবীজির ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরাম এবং আওলিয়ায়ে কেরামের মাঝে মানবসেবার ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছিল।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, প্রিয়নবীর উত্তরসূরি মুসলিম উম্মাহ বা নায়েবে নবীদের মাঝে এখন সেবার প্রবণতা দেখা যায় কম। নবীজির গুণাবলি তাঁর উম্মতের মাঝে না থাকলে ইসলাম টিকে থাকবে কীভাবে?
শিক্ষা দেয়ার কাজ অনেকে করলেও সেবার কাজ বেছে নিয়েছে বিধর্মীরা। বাংলাদেশেই হাজার হাজার মুসলমানকে বিধর্মী করছে সেবা দিয়েই। মুমিন হিসেবে আমাদের কী কিছুই করার নেই?
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তুমি পৃথিবীর মানুষের ওপর দয়া কর, আসমানের মালিক আল্লাহ তোমার ওপর দয়া করবেন।’ আসুন আমরা মানবিক একটা সমাজ গড়ি; একে অন্যকে সাহায্য করি। নবীর আদর্শে উজ্জীবিত হই। সূত্র- যুগান্তর