তথ্যপ্রযুক্তি নারীমুক্তির অন্যতম মাধ্যম। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং এদেশের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণও ব্যপক ভূমিকা রাখতে পারে এবং আমাদের দেশে নারীর অংশগ্রহণ উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে। কারণ আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই নারী। তাই নারীসমাজকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে নারী। তথ্যপ্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার নারীকে তার অধিকার রক্ষায় যেমন এগিয়ে নিতে পারে, তেমনি তার ক্ষমতায়নেও তা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তিতে ভূমিকা রাখা অগণিত নারীর একজন রাজধানীর বাসিন্দা সামিনা রহমান। সংসার-সন্তান সামলানোর পরও তার কিছুটা সময় থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনলাইন ব্যবসাগুলো তাকে আকৃষ্ট করে। একটা পেজ খুলে তিনি সেখানে বিভিন্ন পোশাক বা বাসাবাড়িতে ব্যবহারের প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পেতে থাকেন। কাজের আগ্রহও বাড়ে। ব্যবসা চালানোর জন্য তিনি দুই কর্মী নিয়োগ দেন। দিনে দিনে তার কাজের পরিধি বাড়ছে, হচ্ছে ব্যবসার উন্নতি। তার এই খাতের আয় থেকে কিছু জমিয়ে রাখছেন, আর কিছু খরচ করছেন সংসারে। এতে করে ঘটছে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ধারায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। আর সেই সফল উদ্যোক্তদের মধ্যে সামিনাও জায়গা করে নেন। এভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন, নিয়ন্ত্রণ ও সমতার ভিত্তিতে নারীর পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। পুথিগত বিদ্যায় অনেক বেশি অর্জন না থাকলেও তিনি নিজের চেষ্টা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে গেছেন।
আইসিটির ক্রমবর্ধমান বিকাশ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন যেমন আরও বেগবান হয়েছে, তেমনি নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা ও আইসিটি পেশায় প্রবেশ করার সুযোগ আরও বেড়েছে নারীর ক্ষেত্রে। করোনাকালে মালয়েশিয়ায় লকডাউনের কারণে সেখানকার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী মেহরিন ফাতেমাকে বাংলাদেশে চলে আসতে হয়। এ সময় মালয়েশিয়া থেকে ব্যাগ, জুতা, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস এনে বাংলাদেশে অনলাইনে বেচাকেনার একটি ব্যবসার ধারণা তার মাথায় আসে। গত বছর কঠোর লকডাউনের মধ্যেই তিনি বিজনেস শুরু করেন। বেড়ে যায় তার কাজের ব্যস্ততা। তিনি সহযোগিতা নেন দেশি-বিদেশি বন্ধুদের। দেশে বিভিন্ন সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে মালেশিয়ার পাশাপাশি ব্যবসায় যুক্ত করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের পণ্য। ব্যবসার পাশাপাশি নারী কারিগরদের জন্য কাজ করে এমন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন ফাতেমা। একই সঙ্গে ফাতেমা দেশের যুবসমাজকে নিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করতে থাকেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আত্মবিশ্বাস, নিজস্ব দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নারীরা এখন অনেক এগিয়েছে। এভাবেই একজন নারী শিক্ষিত হলে একটি অঞ্চল এমনকি একটি দেশ সমৃদ্ধ ও উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যে আমাদের নিজের জীবনকেই সহজ করতে পারি তা নয়, এর মাধ্যমে আমরা পুরো দেশকেও পাল্টে ফেলতে পারি। জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে দামি সম্পদ, আর যেদেশের মানুষ লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত, যারা জ্ঞান চর্চা করে, সেদেশ হচ্ছে সম্পদশালী দেশ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞানের দরজা সবার জন্য খোলা।
ডিজিটাল দক্ষতা স্থানীয় সরকারের সঙ্গে নারীদের সম্পৃক্ত হওয়া এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা হলো অন্যের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। শিক্ষা, মেধা ও বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তারা অর্থ উপার্জন করতে পারে সহজেই। বর্তমান সমাজে ‘নারীদের উন্নয়ন এবং অর্থনীতির উন্নতি’ আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি মূলত জেন্ডার-সমতা বিষয়টিকে নির্দেশ করে, যা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের অবস্থানকে স্পষ্ট করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সব বাধা রোধে কাজ করতে হবে আমাদের সবার।
সঠিকভাবে নারীদের জীবন উন্নত করতে যে তথ্য ব্যবহার করা যায়, সে সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ করে দিতে হবে। কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বাজারে ছোট ব্যবসার উন্নতি করা যায়, সে সম্পর্কে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে। নারীদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক উন্নতির জন্য আইসিটি কোর্সে প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ই-লার্নিংয়ের মতো নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নারীরাও এগিয়ে যেতে পারে আরও বলিষ্ঠভাবে। বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটাতে এবং ই-কমার্স খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘ই-বাণিজ্যের সঙ্গে নিজের ব্যবসা গড়ব’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ই-কমার্স-বিষয়ক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে তিন হাজার ৫০০ উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি তার নিজের জীবন, সমাজ ও নিজের সম্প্রদায়ে দক্ষতা স্থাপন করতে পারে। নারীর ক্ষমতায়ন নারীর নিজস্ব মূল্যবোধকে বিকাশিত করতে সাহায্য করে। নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রীয়ভাবে অবস্থানভেদে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখা। নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমতা প্রতিবন্ধকতা অনেক সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে আবদ্ধ। অনেক নারী এ সমস্যাগুলো অনুভব করেন এবং ব্যক্তি ও সমাজের নেতিবাচক আচরণের কারণে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হন।
নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রধান লক্ষ্য। এসডিজির আলোকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের এগিয়ে নিতে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। স্বল্পশিক্ষিত, দরিদ্র ও অসহায় নারীদের আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ ও আইটি প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু নারীদের জন্য ‘শি পাওয়ার’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫ হাজারেরও বেশি নারীকে আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হচ্ছে। তবে নারীর ক্ষমতায়নকে টেকসই করা হচ্ছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সূচকে সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশের যে বিস্ময়কর উত্থান, তার পেছনে নারীর ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি আছে তথ্যপ্রযুক্তি ও এর ব্যবহারের বিশাল ভূমিকা। বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তিকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সবার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে সহজলভ্য করেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে এখন আর তথ্যপ্রযুক্তির সে ভয় নেই। শহরের শিক্ষিত নারীদের কাছ থেকে শুরু করে গ্রামের প্রান্তিক নারীরাও আজ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে বিভিন্নভাবে। ২০২১ সালে আউটসোর্সিং থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার, আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২০ লাখ। নারীর ক্ষমতায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্যবসার ক্ষেত্রে বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি পরিবার হবে স্বাবলম্বী ও ক্ষমতায়িত। আর এর মাধ্যমে অর্জিত হবে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ। দারিদ্র্যশূন্য হবে দেশ। সম্ভব হবে নারীর শতভাগ ক্ষমতায়ন। ফলে বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
পিআইডি নিবন্ধ