প্রিয় বুবু,
বিশ্ব চিকিৎসক দিবস ৩০ শে মার্চ উপলক্ষ্যে তোমার জন্য রইল এক আকাশ ভালোবাসা। চিকিৎসা সেবা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক খুব জরুরি একটি বিষয়। আমার সাথে ভিডিও কলে থাকতে মাঝে মাঝে তুমি হঠাত করে লাইন কেটে দাও, তারপর কিছু পরে টেক্সট পাঠাও, “সরি দিমা, চেম্বারে রোগী এসেছে, তাই কথা বলতে পারছিনা।” তোমার এই ক্ষুদে বারতার মধ্যে দিয়ে রোগী’র প্রতি ডাক্তারের কর্তব্যনিষ্ঠা সহজাতভাবে ফুটে ওঠে।
বিশ্ব চিকিৎসক দিবসটি প্রথম পরিচিতি পায় ৩০ মার্চ ১৯৩৩ সালে। সেই অনুষ্ঠানেই প্রথম স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীর সম্পর্কের ব্যাপারটি বিস্তৃত পরিসরে আলোচিত হয়। এর অনেক পরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ (সিনিয়র) ১৯৯০ সালে ৩০ মার্চকে জাতীয় ডাক্তার দিবস পালনের জন্য আইন পাশ করেন। আজ তোমাকে এবং পৃথিবীর সকল ডাক্তারদের জানাই অপার শ্রদ্ধা বুবু, আব্বা- আম্মা চেয়েছিল, আমিও তোমার মত ডাক্তারি পড়ি। কিন্তু মানুষের মৃতদেহ কাটাকাটি করে চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে হবে, এই ভয়ে আমি কখনো ডাক্তারি পড়তে চাইনি। মেডিকেল কলেজে পড়বার সময় তুমি যখন রাত-দিন গড়গড় করে Gray’s Anatomy মুখস্ত করতে, আমি তখন আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন এর শিল্পিত সিনেমা আর বিশ্বসাহিত্যের পাতায় মন ডুবিয়ে রাখতাম। ডাক্তার হবার ইচ্ছে আমার কখনোই ছিলনা। তখনই আসলে প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছিল, আমাদের দুই বোনের পেশাগত দায়বদ্ধতা’র ক্ষেত্র হবে ভিন্ন। তবে জানো, জীবনে মাত্র একদিন আমার মনে হয়েছিল, ইস্ আমিও যদি বুবু’র মত ডাক্তার হতাম!
সেদিনটি ছিল ২০০৮ সালে ২১ শে মার্চ। বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে একমাস ধরে ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে আব্বা’র শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। দিনে দু’বার কিডনি ডায়ালাইসিস এও আর কোন কাজ হচ্ছেনা। আব্বা পুরোপুরি অচেতন। আব্বার শরীর আর রেস্পন্স করছে না। ২১ তারিখ মাঝরাত নাগাদ বারডেম এর ডাক্তার রা আব্বার ভেন্টিলেশন খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমাকেই তা জানালেন। তুমি, আমি দু’জনেই তখন আইসিইউ এর এটেন্ডেন্ট ফিজিশিয়ান ডাক্তার নাসিরের টেবিলের সামনে। পিন পতন নীরবতা সমগ্র আইসিইউ এর ভিতরে। সারি সারি বেডে শুয়ে আছে (ঘুমিয়ে আছে) ভেন্টিলেশনে সংযুক্ত আরো অনেক পেশেন্ট। আমরা যেখানে দাড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে ত্রিশ ফিট দূরত্বে স্বচ্ছ পর্দার ওপাশে আব্বার বেড। আমরা বুঝে গেছি আব্বার অন্যভুবনে যাত্রা করার সময় এসে গেছে, তাই আমাদের এখন এই সত্যকে মেনে নিতে হবে। ডা: নাসির তোমাকেই বল্লেন, “ডা: তানজিলা, আপনি আসুন আমার সাথে আপনার বাবার বেড এর পাশে। আমরা ওনার ভেন্টিলেশন খুলে দেব।” সেদিন আইসিইউ এর খুব ভেতরে, যেখানটায় রোগীদের নিরাপত্তার কারনে ডাক্তাররা ছাড়া সাধারণ মানুষেরা ঢুকতে পারেনা, সেখানে ডাক্তার নাসির আমাকে ঢুকতে দেননি। আমি দূর থেকে দেখলাম, তুমি এবং বারডেম এর কার্ডিওলজি বিভেগের দু’জন ডাক্তার মিলে আব্বার ভেন্টিলেশন খুলে দিলে। ঠিক সেদিন, সেই মুহুর্তে আমার মনে হয়েছিল, “ইস্ আমিও যদি বুবুর মত ডাক্তার হতাম, তাহলে আজকে এই মূহুর্তটাতে ওরা আমাকেও আব্বার বেড এর পাশে থাকতে দিত।” তারপর ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যেই ট্রলিতে করে আব্বার নির্বাক দেহ আইসিইউ এর বাইরে প্যাসেজে আনা হয়েছিল। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। আইসিইউ এর বাইরে তখন আম্মা কাঁদছেন চুপচাপ। আমি এবং মুন্না আম্মার হাত ধরে আছি দু’জন দুইপাশ থেকে। পাশে মেজমামা, মিঠু চাচা, সামিহা, ইমরান। প্যাসেজে আত্মীয় স্বজনদের ভীড় বাড়ছে একটু একটু করে। আব্বার বন্ধুদের মধ্যে সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী চাচা, আবেদিন চাচা, আনসারি চাচা চলে এসেছেন। আত্মীয়দের কেউ কাদঁছেন, কেউ দোয়া পড়ছেন। আব্বার নিথর দেহ যখন ট্রলিতে করে আমাদের সামনে আনলো ওরা, দেখি দীর্ঘ রোগের যন্ত্রনা থেকে মুক্তির একটা আবেশ আব্বার চির ঘুমন্ত মূখে।
এটিএন বাংলার জনপ্রিয় নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে বাংলাদেশে তখন আমি পরিচিতি’র তুঙে। বারডেম এর ডাক্তারদেরও অনেকেই আমার নিউজ প্রেজেন্টেশন বেশ ভক্ত ছিলেন। বারডেমে আব্বার চিকিৎসার সময়ে আমি যখন যেতাম, অনেক ডাক্তার অনেকবার জানিয়েছিলেন সেকথা। তারপর সেদিন সকাল দশ টা থেকে সারাদিন ধরে এটি এন বাংলার সংবাদে প্রচার হয়েছিল, “আমাদের সহকর্মী দিমা নেফারতিতি’র বাবা দেশের বরেণ্য ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান মারা গেছেন” । তবু সেদিন আমার এক্সেস ছিলনা বারডেম এর আইসিইউ এর খুব ভেতরে, কারণ ওখানটাতে একমাত্র ডাক্তাররা ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারেনা। বুবু, আজ তোমাকে এবং পৃথিবীর সকল ডাক্তারদের জানাই অপার শ্রদ্ধা। চিকিৎসা পেশা যে কত মহান, ডাক্তার মানে যে পরম বন্ধু সেটা আরো কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে। প্রার্থনা করি আমাদের দেশেও ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক হবে আরো বন্ধুত্বের এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধার। মমতা’র চাদরে আবৃত থাকবে সে সম্পর্ক।
লেখক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সংবাদ উপস্থাপিকা এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা