গ্রামে তখন কারেন্ট ছিল না। রাতের খাবার হারিকেনের আলোয় খেতে হত। ছোটবেলায় আমি মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারতাম না। খেতে বসলে আব্বা মাছের কাঁটা বেছে দিতেন। দেখিয়ে দিতেন কিভাবে কাটা বাছতে হয়। যার যত কাজ থাকুক না কেন আমরা সবাই একসাথেই খেতাম। খাবার শেষে আব্বা বলতেন রেডিওটা অন কর,খবরটা শুনি। আমি আব্বার সাথে থাকতাম, িআব্বা খবর শুনতেন আর আম্মাকে বলতেন কি হচ্ছে বিস্তারিত। আম্মা বলতেন একটা টেলিভিশন কিনে ফেলেন। এত রাতের বেলা তাদের ঘরে যেতে ইচ্ছা করে না। তখন আমাদের বাড়ীতে জেঠা টেলিভিশন কিনে ফেলেছে। সময়টা ১৯৮০ /৮১ সাল হবে। ব্যাটারি দিয়ে জ্যাঠা টেলিভিশন চালাত।
এর কয়েক বছর পর আমার বড় বোন আব্বাকে একটা টেলিভিশন কিনে দেয়। আপা তখন স্কুলের শিক্ষিকা। সাদা কালো টেলিভিশন । ব্যাটারি দিয়েই টেলিভিশন চালানো হত। তখন ৩/৪ গ্রাম মিলিয়ে আমাদের বাড়ীতে দুইটা টেলিভিশিন, জেঠার একটা , আমাদের ঘরে একটা। সকালের বাসী পত্রিকা বাজার থেকে এনে বিকালে দিয়ে যেতেন লতিফ চাচা। রেডিও, টেলিভিশন ,পত্রিকা সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছিল যে সারা বিশ্বের খবর আমাদের জানা থাকত। আর গ্রামের মানুষ খবর জানার জন্য ভিড় জমাতো আমাদের বাড়ীতে। শুধু খবর না, নাটক বাংলা সিনেমা , ছায়াছন্দ এগুলো দেখার জন্য অস্থির হয়ে যেত। তবে যে বিষয়টা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তা হল আব্বার সাথে খবর শোনা। আমার সেই অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে। বলা চলে আমার লেখালেখির অভ্যাস ও আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। আব্বা শিক্ষক ছিলেন। যখনি কোন ভালো বই পড়তেন নিয়ে আসত আমাদের জন্য। আমার আম্মা ছিলেন আরেক পড়ুয়া। সারাদিন কাজ করে যতই ক্লান্ত থাকতেন না কেন ,বই পড়া বাদ যেত না। আমি এমন বাবা মায়ের সন্তান ভাবতেই গর্ব হয়।
আসলে ছোটবেলার ঐ সময়টা ছেলেমেয়েরা বাবা মা’র শাসনে, আদরে বড় হয় । আবার বলা যায় ঐ সময়টাতেই সবচেয়ে বেশী কাছে থাকে এবং ভালোবাসা পায়। ছেলে মেয়েরা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, স্কুল পেরিয়ে কলেজ তারপর চাকুরী বা উচ্চশিক্ষা বেড়ে যেতে থাকে দূরত্ব। যতই দূরত্ব বাড়তে থাকে আমরা বাস্তবতার মুখোমুখি হই আর অনুভব করতে থাকি বাবা মা’র চেয়ে এই পৃথিবীতে কেউ আপন নয়। আজ আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী, ৭ মার্চ ২০১২ সালের এই দিনে আমার বাবা মারা যান। সবসময় প্রার্থনা করি বাবা তুমি ভালো থাকো ওপারে।
শুনছো কি বাবা,তোমায় ছাড়া প্রাণ কাঁদে অকাতরে
ঘুমাও শান্তিতে ঘুমাও সারেতিন হাত মাটির ঘরে।
—
এম আর ফারজানা
নিউ জার্সি থেকে।