নিউজস্বাধীন বাংলা : কুমিল্লার সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি সেলিনা ইসলামকে ‘অবরুদ্ধ করে লাঞ্ছিত এবং শ্লীলতাহানী করা হয়েছে’ এমন অভিযোগ তুলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেছেন সাংসদের ব্যক্তিগত সহকার (পিএস) ও চাচাতো ভাই সোহেল।
১৭ জুলাই রাতে ওই ঘটনা ঘটেছে দাবি করে ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ওই মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মুহাম্মদ সাদরিলসহ ১০ জনকে। বিকেল ৫ টার দিকে তাদেরকে থানা থেকে আদালতে প্রেরণ করা হয় ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে। দিকে রিমান্ড আবেদন করতে গিয়ে পুলিশ সেখানে লিখেছেন, গ্রেফতারকৃতরা বিএনপি-জামাতের লোক। তাদের সাথে জঙ্গিসম্পৃক্ত রয়েছে (?) তাই তাদেরকে জিজ্ঞাসবাদে এ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যেতে পারে (!) এ জন্য জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন। এদিকে ৫ নং ওয়ার্ডের স্থায়ী এবং অস্থায়ী বসবাসরত অনেকেই পুলিশের এমন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দলমত নির্বিশেষে তারা ব্যাপরটিকে ‘বাড়াবাড়ি’ উল্লেখ করে বলছেন, কোনো একটি পক্ষের ইন্ধনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ ব্যাপারটিকে জটিল করে তুলছে। পুলিশের আচরণ পুরো পক্ষপাতিত্বমূলক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকাবাসী আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার আসার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এবং এখনও তা বহাল রয়েছে। বেশ কিছু ভালো কাজের মধ্য দিয়ে পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। পুলিশের প্রতি মানুষের নেগেটিভ ধারণাও তিনি বদলে দিয়ে পজেটিভ ভাবতে শিখিয়েছেন। অথচ তারই অঞ্চলে একটি থানা পুলিশের এমন পক্ষপাতিত্ব আচরণ কাম্য নয়। সম্ভবত কোনো একটি মহলের ইন্ধনে পুলিশ এমনটি করেছে এসপির অর্জনকে ¤øান করার লক্ষ্যে।
সাদরিল সম্পর্কে বলতে গিয়ে এলাকাবাসী বলেন, অত্যন্ত সৎ ও সহজ সরল প্রকৃতির ছেলে সাদরিল। সে একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও কখনো সেই ভাব দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করেনি। ছোট বড় সকলের সাথেই ন¤্রতা, ভদ্রতায় কথা বলেন। নিজের সাধ্য মতো তিনি অসহায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সব থেকে বড় কথা, তিনি তার নির্বাচনী ওয়ার্ডে তার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য তা নিষ্ঠার সাথেই পালন করছেন। অথচ তার মতো একজন ক্লিন ইমেজের কাউন্সিলরের সাথে থানার ভেতর পুলিশ যে ধরণের আচরণ করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়।
১৭ জুলাই রাতের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে এলাকাবাসী বলেন, ওই মহিলা এমপিকে শ্লীলতাহানী তো দূরের কথা কেউ লাঞ্ছিত করেনি এমনকি অবরুদ্ধও করেনি। বরং তারা সেদিন যে আচরণ করেছিলেন এলাকাবাসীর সাথে, সেখানে যদি কাউন্সিলর সাদরলি উপস্থিত না হতেন তাহলে হয়তো আরও ভয়াবহ কিছু ঘটতে পারতো। বরং সাদরিলের কারণে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর ক্ষোভ প্রশমিত হয়। অথচ সেই কাউন্সিলরকেই কিনা প্রধান আসামী সাজিয়ে মামলা দায়ের করা হলো এবং কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ডও আবেদন করলো!
স্থানীয়রা আরও বলছেন, সেলিনা ইসলাম একজন সংসদ সদস্য। অথচ তিনি কুমিল্লা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জে আসলেও স্থানীয় থানা পুলিশকে আগের থেকে কিছু জানাননি। তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তাও চাননি। যা তিনি অন্যায় করেছেন। আর থানা পুলিশকে না জানিয়ে এখানে আসার নেপথ্য কারণই ছিলো তিনি এখানে অন্যায়ভাবে কিছু করতেই এসেছিলেন (?) যার কারণে স্থানীয় থানা পুলিশকে না জানিয়ে পিএসকে নিয়ে চলে আসেন সিদ্ধিরগঞ্জের ওমরপুর এলাকায়। এই এলাকার কালু মিয়ার চারতলায় ভাড়া থাকেন তার চাচাতো বোন সালমা বেগম এবং বোন জামাই হাফেজ আহমেদ। মূলত সেলিনা ইসলাম তার বোন ও বোন জামাইয়ের মধ্যকার চলমান বিবাদ মেটাতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি এখানে এসে ঘটিয়ে ফেলেন লঙ্কাকাÐ।
স্থানীয়দের দাবি, কালুর বাড়ির চারতলা ফ্ল্যাটে কী হয়েছিলো তা তাদের জানা নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই রাত দশটার কিছু পর সাড়ে দশটা বা তারও কিছু পর হবে, পুরুষ কণ্ঠে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ শব্দ শুরু হয়। শব্দটি রাতের নিস্তবব্ধতার কারণে দ্রæত ছড়িয়ে যায়। এলাকার মানুষ প্রথমে ডাকাত পড়েছে ভেবে হুড়মুড়িয়ে জড়ো হয় ওই বাড়ির নিচে। এমন সময় সিঁড়ি ভেঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসছিলেন একজন নারী ও পুরুষ (মহিলা এমপি সেলিনা ইসলাম এবং তার পিএস সোহেল)।
স্থানীয়রা বলেন, ওই সময় সবার ধারণা তারা হয়তো উপরে কোনো ধরণের ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, এই ভেবে এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়ে উঠেন। সেলিনা ইসলামও ভয়ে আর বাড়ি থেকে না বেড়িয়ে নিচতলায় অবস্থান নেন। এমন সময় তার পিএস সোহেল পিস্তল বের করে উত্তেজিত জনতাকে ভয় দেখাতে গেলে উত্তেজনা আরও তীব্র হয়। বাইরে পার্কিং করে রাখা কালো রঙের একটি গাড়ির (সেলিনা ইসলামের গাড়ি) গøাস ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন স্থানীয় কাউন্সিলর গোলাম মুহাম্মদ সাদরিল। তিনি এলাকাবাসীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং কালুর বাড়ির নিচতলায় অবস্থান নেওয়া সেলিনা ইসলামের সাথে কথা বলেন।
এলাকাবাসীর দাবি, মূলত সাদরিলের উপস্থিতির কারণে সে যাত্রায় বড় ধরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এরপরই আসে বিপুল সংখ্যক পুলিশ। তারা ঘটনাস্থল থেকে বেশ কজনকে আটক করে এবং সাদরিলকেও থানায় নিয়ে যায় ব্যাপারটি মিটমাট করার কথা বলে।
এদিকে সাদরিলের পিতা সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, আমার ছেলেকে থানা ডেকে নেওয়া হয় মিটমাট করার কথা বলে। কিন্তু সারারাত তাকে থানায় বসিয়ে রাখে। যাচ্ছেতাই ব্যবহারও করা হয়। পরের দিন প্রায় বিকেলের দিকে মামলা রুজু করে সাড়ে পাঁটার দিকে পাঠানো হয় আদালতে। ততক্ষণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। সবই একটা প্ল্যান মনে হয়। তা না হলে দুপুরের মধ্যেই সাদরিলকে আদালতে প্রেরণ করতো।
তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। দেশ আমার কাছে সব থেকে বড়। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি। আমার ছেলেও কখনো অন্যায় করে না। অথচ পুলিশ তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদনে জানিয়েছেন, ‘তার সাথে নাকি জামাত-শিবির জঙ্গিদের সম্পৃক্ত আছে!’ একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তার পরিবার আর যা হোক দেশ বিরোধী কোনো চক্রের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে না।
অথচ, আমার ছেলের প্রতি সেই অভিযোগের তীর তুলছে পুলিশ! এর থেকে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য? এমন পরিস্থিতি দেখবো বলেই কি সেদিন জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, প্রশ্ন তুলেন গিয়াসউদ্দিন।
এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) মীর শাহীন শাহ পারভেজ বলেন, সেলিনা ইসলাম আসার আগে আমাদেরকে কিছু জানায়নি। তিনি চাইলে পুলিশ তাকে অবশ্যই সিকিউরিটি দিতেন। হয়তো পারিবারিক কাজে এসেছেন তাই জানানোর দরকার মনে করেননি।
অতদূর থেকে একজন এমপি আসছেন সে হিসেবে লোকাল থানাকে জানানো দরকার ছিলো কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি শাহীন শাহ পারভেজ বলেন, এমন কোনো নিয়ম আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে, তিনি আমাদেরকে কিছু জানাননি। কোনো এমপি যদি আমাদের থানা এড়িয়া পাড় হওয়ার সময় প্রটোকল চায় তাহলে সেটি আমরা দিই। সেটি নিয়ম আছে।
এদিকে এলাকাবাসীদের কেউ কেউ জানিয়েছিলেন সেদিন অমন পরিস্থিতিতে পুলিশকে কাউন্সিলর সাদরিলই ফোন করেছিলেন। এর সত্যতা জানতে চাইলে ওসি বলেন, প্রশ্নই উঠে না, সাদরিল আমাকে ফোন করেনি। গত সাত মাসেও তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়নি। তবে, কে ফোন করেছিলো সেটি তিনি নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি। এছাড়াও কালুর বাড়ির চারতলা থেকে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকার সম্পর্কে জানতেই চাইলে তিনি এর কোনো ব্যাখ্যা বা কারণ কি, তা জানাতে পারেননি।